Header Ads

Header ADS

 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

তারিখটা ছিল ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ। টেমস নদী থেকে মাত্র ২০ মিনিটের হাঁটাপথ দূরত্ত্বে মুরগেট ফিল্ডের ফাউন্ডার্স হল তখন গম গম করছে লোকজনের সমাগমে। কে নেই সেখানে ? লন্ডনের মেয়র স্টিফেন সোম আছেন, আছেন লন্ডনের অডিটর জেনারেল টমাস স্মিথ (তিনি আবার জাঁদরেল ব্যবসায়ী ও লেভান্ট কোম্পানির হর্তাকর্তাও বটে), আছেন বিখ্যাত অভিযাত্রী উইলিয়াম বাফিন। শুধু এনারা ? মুদির দোকানদার থেকে ধোপা, মুচি থেকে নাবিক - সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষও উপস্থিত আছে ফাউন্ডার্স হলে। এঁদের সবার এখানে আসার কারণ খুব সরল - অর্থ ও জাতীয় অস্মিতার যৌথ লক্ষ্যকে ছোঁয়ার জন্য এক আবেদন রচনা। পরিষ্কার হলো না তো ? আচ্ছা, একটু পিছিয়ে আসি তাহলে।

আমরা যে সময়ের কথা বলছি, ক্রিস্টোফার কলোম্বাসের ভারতের খোঁজে আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের বিখ্যাত ভ্রান্তির একশো বছর অতিক্রান্ত। সেই 'ওয়েস্ট ইন্ডিজ'-এ তখন পর্তুগিজ ও স্প্যানিশদের রমরমা উপনিবেশ ও ব্যবসা। ঈশ্বর সাগর সৃষ্টি করেছেনই যেন পর্তুগিজ ও স্প্যানিশদের ব্যবসা করার জন্য। কারণ ইউরোপের অন্য দেশের নাবিকরা যেখানেই যায়, সেখানেই দেখে এই দুই দেশের লোকেরা আগে ভাগেই ঘাঁটি গেড়ে ব্যবসা বাগিয়ে বসে আছে। দীর্ঘদিন ধরে ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের একটা বড়ো ঘাঁটি ছিল সিরিয়ার আলেপ্পো। সেখান থেকে পূর্ব দেশের মশলা ইউরোপে চালান দিয়ে তাঁদের বেশ দু-পয়সা আয় হত। কিন্তু যখন থেকে পর্তুগিজরা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে তখন থেকে তারা আর স্পেনের বণিকরা মাঝখানের আরব পাইকারদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরাসরি ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মশলা ইউরোপে রপ্তানি করছে। আরব ও তুর্কিদের হাত ঘুরে আসা মশলা কিনে তা আবার ইউরোপের বাজারে বিক্রি করে লাভ রাখতে হয় ইংরেজদের। দামটা তাই চড়া-ই রাখতে হয় ইংরেজ বণিকদের। অন্যদিকে সরাসরি আমদানী করার সুবাদে অনেক কম দামে স্প্যানিশ ও পর্তুগিজরা মশলা বিক্রি করছে। ফলে, বলাই বাহুল্য, প্রতিযোগিতায় পিছু হটছে ইংরেজরা। ক্রমশ লেভান্ট কোম্পানির বণিকরা বুঝলেন, ব্যবসায় টিকতে গেলে সরাসরি ভারতে ঘাঁটি করে ব্যবসা করতে হবে, যেমন পর্তুগিজরা করছে। প্রথম অভিযান হল ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে। র‍্যালফ ফিচ 'টাইগার' নামক জাহাজে চড়ে যাত্রা করলেন ইস্ট ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিধি বাম, হর্মুজ প্রণালী সবে পেরিয়েছেন, পর্তুগিজরা তাঁকে বন্দী করল। আরব সাগর তাদের খাস তালুক, এখানে অন্য ইউরোপীয়কে তারা বরদাস্ত করবেন না। শেষে গোয়া, আগ্রা, বাংলা, মালাক্কা হয়ে অনেক ঘাটের জল খেয়ে র‍্যালফ ফিচ দেশে ফিরলেন বটে কিন্তু এক দানা গোলমরিচও তিনি আনতে পারেননি। এর পরের চেষ্টা হল ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, স্যার জেমস ল্যাঙ্কাস্টার চারটে জাহাজ সাজিয়ে লোক লস্কর, সৈন্য সামন্ত, কামান বন্দুক নিয়ে উত্তমাশার পথে ভারতের দিকে রওনা দিলেন। একটা মাত্র জাহাজ ফিরে আসল,তাও খুব অল্প গোলমরিচ নিয়ে। বলা বাহুল্য, বারবার এইরকম সাংঘাতিক ব্যর্থতার ফলে ইংরেজ বণিকদের দুর্নাম রটে গেল। অন্যান্য ইউরোপিয়ানরা দুয়ো দিতে লাগল। স্প্যানিশ আর্মাডা ধ্বংসসাধন এবং ওয়াল্টার র‍্যালে আর স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকের দুঃসাহসিক নৌ অভিযান নাবিক হিসবে ইংল্যান্ডবাসীর যে খ্যাতির জন্ম দিয়েছিল, তা বুঝি যায় যায়। এর মধ্যে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল ডাচরা। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯-শে জুলাই খবর এল ডাচ কোম্পানি ভ্যাম ভেরে-এর একটা জাহাজ ইন্দোনেশিয়া থেকে ফিরেছে। অ্যাডমিরাল জ্যাকোব কর্নেলিসেজুন ভ্যান নেক দেশে ফিরেছেন ৪০০ টন গোলমরিচ, ২০০ টন লবঙ্গ এবং প্রচুর দারচিনী নিয়ে। কোম্পানির লাভ হয়েছে প্রায় ৪০০%। নেদারল্যান্ডের মতো ছোট্ট দেশ, যারা স্বাধীনতা পেয়েছে ২০ বছরও হয়নি, তারা কিনা বাণিজ্যে ইংল্যান্ডকে টেক্কা দিচ্ছে ! এ তো আর লাভ ক্ষতির প্রশ্ন না ! এ তো পুরো জাতীয় সম্মান নিয়ে টানাটানি। এর মধ্যে মিছরির ছুরি চালিয়েছে অ্যামস্টারডাম। তারা ইংল্যান্ডকে খুব বিনীত ভাবেই এক প্রস্তাব দিয়েছে - কিছুই না, ইংল্যান্ডের বাণিজ্য তরীগুলোতো এমনিই পড়ে আছে, ওগুলো দিয়ে তো কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না, পালে মাকড়শা জাল বুনছে। এমনিতেও বোঝাই যাচ্ছে, ইস্ট ইন্ডিজে ব্যবসা করা ইংল্যান্ডের কপালে নেই। তা যদি ইংরেজরা ডাচদের ওগুলো বিক্রি করে দেন, তবে জাহাজগুলো পড়ে পড়ে পচবে না। - এত বড়ো কথা ! এই প্রস্তাব শুনে ইংল্যান্ডের তাবড় তাবড় বণিক ও রাজনীতিবিদরা ঠিক করলেন, এর একটা যোগ্য জবাব দিতে হবে। তাঁরা ডাচদের বলে পাঠালেন - 'Our merchants of London have need of all our ships and none to sell to the Dutch. We ourselves intend forthwith to have trade with East Indies.' আর তারপরেই ডাকা হল ২৪ শে সেপ্টেম্বরের প্রথমোক্ত সেই মিটিং। মনাফা করতেও হবে আর দেশের সম্মানও রক্ষা করতে হবে। এর জন্য দরকার ইস্ট ইন্ডিয়ার বাণিজ্যে স্প্যানিশ, পর্তুগাল আর ডাচদের টেক্কা দেওয়া। এই মর্মে দরকার একটা নতুন কোম্পানির। সভায় উপস্থিত সভ্যদের সম্মতিক্রমে মহারানী প্রথম এলিজাবেথের নিকট প্রেরণের জন্য সেই কোম্পানি খোলার দাবী সনদ রচিত হল। কোম্পানির উদ্দেশ্য ? - '…to venter in the pretended voiage to ye Est Indies and other Ilands and Cuntries thereabouts there to make trade…by buying or bartering of suche goods, wares, jewelles or merchaundize as those Ilands or Cuntries may yeld or afforthe…(the whiche it maie please the Lorde to prosper).' আর কোম্পানির নাম ? 'Governor and Company of Merchants of London trading to the East Indies' বা সংক্ষেপে 'East India Company'। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর ২১৮ জন কর্মচারী নিয়ে কোম্পানির পথচলা যখন শুরু হল, তখন তার কর্তাব্যক্তিদের খুব উচ্চ কিছু লক্ষ্য ছিল না। তাঁদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দুটো - ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করে মুনাফা করা আর স্প্যানিশ, পর্তুগিজ আর ডাচদের একটা মুখের মতন জবাব দেওয়া। বলাই বাহুল্য, এই লক্ষ্য পূরন হয়েছিল। কালক্রমে সমগ্র এশিয়া যে সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠানের ভয়ে কাঁপবে, যে প্রতিষ্ঠানের এক অঙ্গুলিহেলনে শতাব্দী প্রাচীন রাজা বাদশার মুকুট খসে যাবে, যে প্রতিষ্ঠানকে দেখে এডমন্ড বার্ক মন্তব্য করবেন - 'a state in the guise of merchant', সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সূচনা হয়েছিল এইভাবেই।

স্যার টমাস স্মিথ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর

No comments

Powered by Blogger.