Header Ads

Header ADS


(ভূচিত্রে পুর্ব এবং পশ্চিম বাংলার অবস্থান দেখানো হচ্ছে।)

বাংলাকে কে ভাগ করেন, এই উত্তরের খোঁজে নিচের চারটি প্রতিবেদন পড়ুন।

(ক) বাংলা ভাগ
একটা প্রবাদ আছে যতো দোষ, নন্দ ঘোষ । নন্দ ঘোষের প্রতি দোষের ইতিহাস না জানলেও যাঁর সম্পর্কে এই আলোচনা করছি, এই বিষয় সম্পর্কে তাঁর দোষ কতটা বা অন্যের দোষ কি তাঁর উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ? তবে কেন ? তাহলে আসল দোষী কে বা কারা ? আর কেনই বা তাঁরা যোগেন্দ্রনাথের উপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিতে চাইছে ? কি ই বা তাদের উদ্দেশ্য ? এ সব বিষয়ের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করছি ।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর একটা কথা আছে, ‘দেশভাগ হোক না হোক বাংলাকে অবশ্যই ভাগ করতে হবে ।” কেন ? একবার পাঠকগণ ভেবে দেখুন বা তথ্য খুঁজে দেখুনতো ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ এর পূর্বে সমগ্র (পূর্ব ও পশ্চিম) বাংলায় কোন ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণীয়দের শাসন ছিল কি ? আর এই সময়ের পরে পশ্চিম বাংলায় কোননিম্ন বর্ণীয়দের শাসন এসেছে কি ? আশাকরি, বিদগ্ধ পাঠক বুঝতে পেরেছেন শ্যামাপ্রসাদ কেন ঐ কথা বলেছিলেন ।
শুধু এই কারণটাই নয়, বাংলা ভাগের অন্যান্য মুখ্য কারণগুলি হলো-
প্রথম কারণঃ- বাংলা প্রান্তে মুসলিম এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেনীর (বিশেষ করে নমঃশুদ্র) লোকদের সংখ্যাসর্বাধিক ছিল । সেখানে মুসলিম লীগের সরকার ছিল । যদি বাংলার বিভাজন না হয় তাহলে মুসলিম আর পিছিয়েপড়া শ্রেনীর সত্তা চিরস্থায়ী হবে । সেখানে উচ্চবর্ণীয়দের কোন অধিকার থাকবে না ।

দ্বিতীয় কারণঃ- বাংলার খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল এই এলাকা থেকে বাবা সাহেবকে নির্বাচিত করে সংবিধান সভায় পাঠানো হয় । তাই বাংলা বিভাজন করে বাবাসাহেব যে ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সেখান থেকে বাবাসাহেবের সদস্য পদ খারিজ করার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাগ করে ছিল ।

তৃতীয় কারণঃ- যে নমঃ (শুদ্র) রা বাবা সাহেবকে সংবিধান সভায় নির্বাচিত করে পাঠিয়েছেলেন তাদেরকে সাজা দেওয়ার জন্য যাতে তারা আজীবন মুসলমানদের আধীন থাকে, এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাংলা ভাগ করেছিল ।
আর একটা কারণ, সেটা আপনারা মানুন আর নাইবা মানুন; সেটা হচ্ছে-
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল হচ্ছেন বাংলার আম্বেদকর । তাঁর ক্ষমতা কত সুদূর প্রসারী ও শক্তিশালী, সেটা তাঁর থেকে উপকার প্রাপ্তরা কতটা বুঝেছেন বলা মুশকিল । তবে উচ্চবর্ণীয়রা সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরে ছিলেন বাখার গঞ্জ কেন্দ্রের জয় থেকে শুরু করে বাবা সাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠানো পর্যন্ত । যার জন্য তারা হর পল মহাপ্রাণের লাগামকে নিজেদের কন্ট্রোলের বাইরে যেতে দেয়নি । বরং সব সময় যোগেন্দ্রনাথে বিরুদ্ধে নিজের জাতির লোক দিয়ে যেমন বিরোধীতা করিয়েছে । তেমনি তারা বুঝতে পেরেছিল,বাংলা ভাগ না হলে কোন দিনই উচ্চবর্নীয়দের কব্জায় বাংলার শাসন ক্ষমতা আসবে না । তাই গোদের উপর বিষফোড়াটাকে স্বমূলে নির্মুল করার জন্য বাংলা ভাগ করা তাদের কাছে অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে । এখানে আর একটা কথা বলে রাখি ঐ সময়ে নেতাজীর অন্তরধান হওয়া উচ্চবর্ণীয়দের বাংলা ভাগ করার কাজটি সুগম হয় ।
আপনারা হয়তঃ জানেন । যে গান্ধীর কথা স্কুলে পড়ানো হয়, যে “দেশভাগ হতে হলে আমার মৃত শরীরে উপর দিয়ে যেতে হবে।”
সেই গান্ধীর উপস্থিতিতে ১৯৪২ সালে ১৫ই জুন কংগ্রেসের অধিবেশনে দেশভাগের প্রস্তাব পাশ হয় ।
(তথ্যঃ- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ৩য় খণ্ড লেখক- জগদীশ চন্দ্র মন্ডল)

(যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল আধুনিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ও শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যক্তিত্ব এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। সংবিধান প্রণেতা হিসেবে দেশের আইন ও শ্রম মন্ত্রী ছিলেন। এছাড়াও তিনি কমনওয়েলথ ও কাশ্মীর বিষয়ক দ্বিতীয় মন্ত্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। উইকিপিডিয়া)

(ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন। তিনি জওহরলাল নেহেরুর ক্যাবিনেটের মন্ত্রী ছিলেন।)
এতোকিছু প্লান মাফিক হওয়ার পরেও বাংলা ভাগের জন্য দোষ চাপিয়ে দেওয়া হ’ল যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের উপর । কেন ? কারণ, আপনারা জানেন, দুর্বা ঘাস প্রচন্ড রোদের শুকিয়ে গেলেও আবার বর্ষার জল পেলে জেগেওঠে । যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল সেই জাতের লোক ছিলেন । যার প্রমান ‘মায়ের ডাক’ পত্রিকায় একবার প্রকাশিত হয়, “যোগেন মন্ডলরা আবার যাগছে ।” অর্থাৎ কোন প্রকারেই নিশ্চিহ্ন করতে পারছিল না উচ্চবর্ণীয়রা । যার জন্য তারা যোগেন্দ্রনাথের উপর তাদের মিথ্যা অপবাদের শক্তিসেল প্রয়োগ করে । পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করে যে, তাঁর সঙ্গে কেউ দিবালোকেও দেখা করতে যেতে সাহস পেতেন না লজ্জায় । বর্তমানে সেইপরিস্থিতি থেকে অনেক উত্তরোণ ঘটলেও কিন্তু শত্রু পক্ষ তাঁরই সমাজের লোকের মধ্যে তাঁর নামে বিভিন্ন ভাবে মিথ্যা প্রচার করেই চলেছে । আর তাঁরই শ্রমের বিনিময়ে সংরক্ষিত সংরক্ষণের (১৯৬৫ এর লকুড় কমিটির সুপারিশ বন্ধ করে নমঃশূদ্র, দাস, সুড়ি/সাহা ও রাজবংশীদের তপশিলী জাতির অন্তর্ভুক্ত করে রাখেন।) সুবিধা নিয়ে সরকারী চাকরী করে তাঁর প্রতি বিষ উগরে দিচ্ছে । একটা জাতির পক্ষে এর থেকে লজ্জা ও ঘৃণার আর কি হ’তে পারে !!! এই গোলামদের কোন গ্রেড দেবেন আপনারা ?
বাঙ্গলা বিভাজন যাতে না হয় তার জন্য ১৯৪৭ সালে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বাংলা বিভাজনের বিরুদ্ধে লোকদের জাগৃত করার কাজ করেন । খড়িবাড়ি (দার্জিলিং) , জলপাইগুড়ী, দিনাজপুর, হরিনারায়নপুর, খোলাপোতা গ্রাম(২৪ পরগনা ) কলকাতা, বর্ধমান, বীরভুম, হুগলী ইত্যাদি জায়গায় বাংলা বিভাজনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন । যেকোন পরিস্থিতিতে তিনি বাংলাকে বিভাজিত হ’তে বন্ধকরার চেষ্টা করেছিলেন।
বাংলা বিভাজনের পক্ষেকংগ্রেস আর উচ্চবর্নীয়রা কেন ছিল সেটা জানা খুব দরকার । এবিষয়ে সরাসরি তুলে দিলাম নিচের অংশ । অনুসন্ধানী পাঠকরা আশাকরি, বুঝতে পারবেন যে, কাদের স্বার্থে ও চক্রান্তে বাংলা ভাগ হয়েছিল । আর যেকাজে যোগেন্র্ঝনাথের কোন অংশগ্রহণই ছিল না তিনি কি করে সেই কাজের জন্য দোষী হন ??? দেখুন নিচেরঅংশ । আর জানান আপনার মতামত ।
বঙ্গীয় ব্যবস্থাপরিষদে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব গৃহীতঃ-
বৃটিশ গভর্ণমেন্টের ৩ জুনের ঘোষণা অনুযায়ী ২০ জুন, বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল সমূহের প্রতিনিধিগণ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুইটি পৃথক সভায় মিলিত হলেন । হিন্দু প্রধান জিলাগুলির হিন্দু ও মুসলমান সদস্যগণ একটি সভায় মিলিত হলেন এবং মুলসমান প্রধান জিজাগুলীর হিন্দু ও মুসলমান সদস্যগণ আর একটি পৃথক সভায় মিলিত হলেন । বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, হুগলি, হাওড়া, কলকাতা, ২৪ পরগণা, খুলনা, জলপাইগুড়ি এবং দার্লিলিং এই এগারটি হিন্দুপ্রধান জিলার হিন্দু ও মুসলমান সদস্যগণ যে সভায় মিলিত হলেন তাতে সভাপতিত্ব করলেন বর্ধমানের মহারাজা স্যার উদয়চাঁদ মহতাব এবং মুসলমান প্রধান জিলাগুলির হিন্দু ও মুসলমান সদস্যগণ মিঃ নূরুল আমিনের সভাপতিত্বে একটি পৃথক সভায় মিলিত হলেন । প্রথমদিকে কংগ্রেস পক্ষের দাবিতে উভয় অধিবেশনে সমগ্র বাঙলা বর্তমান গণপরিষদে যোগদান করবে বলে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয় । এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ১২৬ ভোট এবং পক্ষে ৯০ ভোট হওয়ায় প্রস্তাবটি আগ্রাহ্য হয় ।
পরে হিন্দুপ্রধান অঞ্চলের প্রতিনিধিগণের সভায় বঙ্গবিভাগের প্রস্তাব উত্থাপিত হয় । উক্ত প্রস্তাবটি ৫৮-২১ ভোটে গৃহীত হয়। এই অংশের শাসনতন্ত্র প্রণনের উদ্দেশ্য বর্তমান গণপরিষদে যোগদানের প্রস্তাব ৫৮-২১ ভোটে গৃহীত হয় । অপরপক্ষে মুসলমান প্রধান অঞ্চলের সসস্যগণের সভায় বঙ্গবিভাগের বিরুদ্ধে ১০৬ জন ও পক্ষে ৩৪ জন কংগেসী সদস্য ভোট প্রদান করেন । এই অংশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবার জন্য বর্তমান গণপরিষদে যোগদান করবে না, মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলির জন্য যে নতুন গণপরিষদ গঠি হবে, সেই গণপরিষদে যোগদান করবে তার একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয় । মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলির জন্য যে নতুন গণপরিষদ গঠিত হবে, সেই গণপরিষদের যোগদানের প্রস্তাবের পক্ষে ১০৭ জন ও বিপক্ষে ৩৪ জন ভোট প্রদান করায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয় । মুসলমান প্রধান সদস্যদের সভায় আর একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাহলে উক্ত জেলাকে পূর্ববঙ্গ নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে নিতে স্বীকৃত আছে । ১০৫-৩৪ ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় । এই অংশের কংগ্রেসী ৩৪ জন সদস্য প্রত্যকটি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন ।
বাঙলা ভাগের যে ভোটাভুটি হয় তাতে যারা অংশ গ্রহণ করেন, তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলঃ-
এই ভোটাভোটিতে মোট ২২৫ জন সদস্য অংশ গ্রহণ করেন । তন্মধ্যে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চলের ৮০ জন এবং মুসলমান গরিষ্ঠ অঞ্চলের ১৪৫ জন। ইউরোপীয়ান ২৫ ভোট দানে বিরত থাকেন । হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ এলাকার ৮০ জনের মধ্যে, হিন্দু ৫৮ জন, মুসলমান ২১ জন, এয়াংলো ইন্ডিয়ান ৪ জন এবং ভারতীয় খৃষ্টান ১ জন ।
উক্ত ৫৪ জন হিন্দুর মধ্যে অ-কংগ্রেসী ভোটার ৫ জন । তারা হলেন – ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী (হিন্দু মহাসভা) মহারাজা ধিরাজ স্যার উদয়চাঁদ মহতাব (স্বতন্ত্র), মুকুন্দবিহারী মল্লিক (স্বতন্ত্র), রতনলাল ব্রাহ্মণ (কমিউনিষ্ট) এবং জ্যোতি বসু (কমিউনিষ্ট) ।

(হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী বাঙ্গালী রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।)
২১ জন মুসলমানের বিশিষ্টদের মধ্যে মিঃ এস. এইচ. সোহারাবর্দী (মূখ্যমন্ত্রী),মিঃ এম. এ. এই. ইস্‌পাহানী (মুসলিম লীগের কার্যকরী সমিটির সদস্য), মিঃ আবুল হুসের (সম্পাদক, বঙ্গীয় মুসলিম লীগ), মিঃ আবদুর রহমান (সমবায় ও ত্রাণ দপ্তরের মন্ত্রী) এবং নবাব মুসারফ হোসেন ।
মুসলমান সংখ্যা গরিষ্টদের এলাকায় হিন্দু কিরণশঙ্কর রায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (যথাক্রমে কংগ্রেস এসেমব্লি পার্টির নেতা ও উপনেতা), নেলী সেনগুপ্ত এবং পি. আর. ঠাকুর (প্রমথরঞ্জন ঠাকুর) ।
মুসলমান গরিষ্ঠ অঞ্চলের ১৪৫ জনের মধ্যে, মুসলমান ১০৩ জন, হিন্দু ৪১ জন, ভারতীয় খৃষ্ঠান ১ জন ।
৪১ জন হিন্দুর মধ্যে ৬ জন অ-কংগ্রেসী তফশিলী সদস্য, তন্মধ্যে মন্ত্রীদ্বয় দ্বারিকনাথ বারুরী ও নগেন্দ্র নারায়ণ রায়, মহারাজা গিরিশচন্দ্র নন্দী, সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, ভোলানাথ বিশ্বাস, হারাণচন্দ্র বর্মণ (উপয় পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী), গয়ানাথ বিশ্বাস (ময়মন সিং) এবং একজন কমিউনিষ্ট সদস্য ছিলেন ।
মুসলমানদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লিখিত মিঃ এ.কে. ফজলুল হক, মিঃ মহাম্মদ আলি (রাজস্ব মন্ত্রী), মিঃ নুরুল আমিন (স্পিকার), মিঃ আহম্মদ হোসেন (কৃষি মন্ত্রী), মিঃ সামসুদ্দীন আহম্মদ (শ্রম ও বাণিজ্যমন্ত্রী) অন্যতম ।
পশিমবঙ্গ ব্লকের দুইটি হিন্দু আসন, যথাক্রমে কলিকাতা পূর্ব (সাধারণ) এবং জলপাইগুড়ি- শিলিগুড়ি সাধারণ (তফশিলী আসন দুটিকে ভোট থেকে বিরত রাখা হয় । তাছাড়া, বাখরগঞ্জ দক্ষিণ- পশ্চিম সাধারণ ( তফশিলী) আসনটিকেও ভোট থেকে বিরত রাখা হয় ।
বাখরগঞ্জ দক্ষিন- পশ্চিম সাধারণ তফশিলী আসনটির নির্বাচিত সদস্য আমাদের যোগেন্দ্রনাথ।

(খ)১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গ ভারতবর্ষ বিভক্তির একটি অংশ হিসেবে ধর্মের উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত বঙ্গ প্রদেশ ভারত এবং পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বিভক্ত হয়। প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত "পশ্চিম বঙ্গ" ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত "পূর্ব বঙ্গ" পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। ৩ জুন পরিকল্পনা বা মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ অগাস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান এবং ভারতের নিকট এই নতুন ভাবে বিভক্ত বাংলা প্রদেশের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান যা পাকিস্তানের প্রদেশ ছিল, তা ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

  • মুসলিম প্রধান জেলা: দিনাজপুর, রংপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, নাদিয়া, ঢাকা, , ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, নোয়াখালি, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম।
  • হিন্দু প্রধান জেলা: কলকাতা, হাওড়া, হুগলী, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, যশোর, খুলনা।
  • বৌদ্ধ প্রধান জেলা: পার্বত্য চট্টগ্রাম।

চুড়ান্ত ভাগ:

  • পাকিস্তান: পূর্ব দিনাজপুর,রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিলেট (বরক উপত্যকা ছাড়া), পূর্ব নাদিয়া, ঢাকা, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, নোয়াখালি, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম।
  • ভারত: কলকাতা, হাওড়া, হুগলী, বীর্ভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম দিনাজপুর, পশ্চিম নাদিয়া, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, বরাক উপত্যকা (অধুনা আসাম রাজ্যের অংশ)।

(পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মানচিত্র।)

পটভূমি

১৯৪৭ সালের বাঙলা বিভক্তির পূর্বে,১৯০৫ সালে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সহজতর করার লক্ষ্যে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলায় বিভক্ত করা হয় যা বঙ্গ ভঙ্গ হিসেবে পরিচিত।

(ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই স্থপতি গান্ধী ও নেহেরু।)

সে সময় পশ্চিমবাংলা ছিল হিন্দু অধ্যুসিত এবং মুসলিমরা সেখানে সংখ্যালঘু, অন্যদিকে পূর্ববাংলা ছিল মুসলিম অধ্যুসিত এবং হিন্দুরা ছিল সংখ্যালঘু। মুসলিম অধ্যুসিত পূর্ববাংলার মানুষ এই বঙ্গ ভঙ্গের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছিল, কেননা তারা উপলব্ধি করেছিল যে এই বিভক্তির মাধ্যমে তারা তাদের নিজস্ব একটি প্রদেশ পেতে পারে। কিন্তু হিন্দুরা এই বিভক্তির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। এই বিতর্ক পরবর্তীকালে প্রতিবাদ এবং সন্ত্রাসের জন্ম দেয় এবং ১৯১১ সালে বঙ্গ ভঙ্গ রদের মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি করা হয়।

১৯০৫ সালের বাঙলা বিভক্তির সময়ে হিন্দু এবং মুসলিমদের মাঝে সৃষ্টি হওয়া এই মতানৈক্য পরবর্তীকালে আবারো বিতর্ক তৈরি করে যা আইন তৈরী, এমনকি ১৯৪৭ সালের বাঙলা বিভক্তিতে প্রভাব রেখেছে এবং সেই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা হিসেবে বারংবার সামনে এসেছে।

বিভক্তিকরণ

পরিকল্পনা অনুসারে, ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্যগণ বাঙলা বিভক্তিকরণ প্রস্তাবের উপরে তিনটি আলাদা ভোট প্রদান করেন।

  • পরিষদের সকল সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ অধিবেশনে, যৌথ অধিবেশন বিভক্তিকরণের পক্ষে ১২৬ ভোট এবং বিদ্যমান সংবিধান পরিষদের যোগ দেওয়ার পক্ষে ৯০ ভোট (অর্থাৎ, ভারত) প্রণীত হয়।
  • তারপর একটি পৃথক অধিবেশনে বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় সদস্যগণ, বাংলার বিভক্তি এবং সম্পূর্ণ একটি নতুন গণপরিষদ (অর্থাৎ, পাকিস্তান ) এ যোগদান করার সপক্ষে ভোট প্রদান করেন; যেখানে নতুন রাষ্ট্রে যোগদানের সপক্ষে ১০৬ এবং বিপক্ষে ৩৫ টি ভোট প্রণীত হয়।
  • একই পদ্ধতি বাংলার মুসলিম অধ্যুসিত নয়, এমন স্থানগুলোতেও অনুসরণ করা হয়েছিল। সেখানে ৫৮ ভোট বিভক্তিকরণের পক্ষে এবং ২১ ভোট বিপক্ষে প্রণীত হয়।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুযায়ী, যদি একটিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট বিভক্তিকরণের পক্ষে প্রণীত হয় তাহলে প্রদেশ বিভক্ত হবে । এই পরিকল্পনাকে তুলে ধরে, ২০ জুন পরিষদে ভোটাভুটির ফলফলের প্রেক্ষিতে পশ্চিম বাঙলা প্রদেশ ভারত এবং পূর্ব বাঙলা প্রদেশ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।এছাড়াও, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে,৭ জুলাই অনুষ্ঠিত একটি গণভোটে, সিলেটের নির্বাচকমণ্ডলী পূর্ব বাঙলা প্রদেশে যোগদানের সপক্ষে ভোট প্রদান করে।

পরবর্তীতে স্যার সাইরিল র‍্যাডক্লিফ এর নেতৃত্বে সীমানা কমিশন দুই নব নির্মিত প্রদেশের মধ্যে আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ অনুসারে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

বাঙলা সমন্বিতকরণ পরিকল্পনা

"দ্বিজাতিতত্ব" এর উপর ভিত্তি করে ভারতের বিভক্তির পরে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এখানে ধর্মীয় বিষয়টিকে মুখ্য বিবেচনা করা হয়েছে। তখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি ভিত্তিগত পরিকল্পনা পেশ করেন যে, পূর্ব এবং পশ্চিম বাঙলা ভারত কিংবা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে না যুক্ত হয়ে বরং একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে । সোহরাওয়ার্দী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, যদি বাঙলা এভাবে বিভক্ত হয় তবে পূর্ব বাঙলা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে কেননা, সব কয়লা খনি কিংবা পাট কল পশ্চিম বাংলার অংশ হয়ে যাবে এবং একটি সিংহভাগ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যারা কিনা শিল্পায়নের সাথে যুক্ত পশ্চিম বাংলায় অভিবাসন সম্পন্ন করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, 'কোলকাতা' যা ভারতের অন্যতম প্রধান শহর এবং শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু তা পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সোহরাওয়ার্দী ২৪ এপ্রিল, ১৯৪৭ সালে দিল্লির একটি সংবাদ সম্মেলনে তার প্রস্তাব তুলে ধরেন।

তবে পরিকল্পনাটি সরাসরি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ (ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ছিলো এবং দ্বিজাতিতত্বের আলোকে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিলো) বাতিল করে দেয়। প্রাথমিকভাবে, বাঙলা প্রদেশের মুসলিমলীগ নেতারা দ্বিধা বিভক্ত ছিলেন। বর্ধমানের নেতা আবুল হাসিম সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং অন্যদিকে,নুরুল আমিন এবং মোহাম্মদ আকরাম খান এর বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবের বৈধতা বুঝতে পেরে পরিকল্পনাকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছিলেন।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর সমর্থন লাভের পর সোহরাওয়ার্দী তার পরিকল্পনার সপক্ষে সমর্থন জমায়েত শুরু করেন।

কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গুটিকয়েক নেতাই এই পরিকল্পনার সাথে একমত ছিলেন। তাদের মাঝে ছিলেন বাঙলা প্রদেশের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা এবং নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসের বড় ভাই শরৎ চন্দ্র বোস এবং কিরণ সংকর রয়। তবে, জওহরলাল নেহেরু এবং ভাল্লাবভাই পাতিল সহ বেশিরভাগ বিপিসিসি নেতা এই পরিকল্পনা বাতিল করেন। এছাড়াও শ্যাম প্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল এর তীব্রভাবে বিরোধিতা করে। তাদের মতামত ছিলো যে, এই পরিকল্পনা আসলে বিভক্তিকরনের বিপক্ষে সোহরাওয়ার্দীর দ্বারা একটি চাল মাত্র যাতে কলকাতা শহর সহ শিল্পোন্নত পশ্চিম অংশের উপর লীগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। তারা আরো মতামত পোষণ করেছিলেন যে, যদিও পরিকল্পনায় একটি সার্বভৌম বাংলার কথা উল্লেখ করা আছে, এটা বাস্তবিক পক্ষে একটি ভার্চুয়াল পাকিস্তান ছাড়া কিছুই হবে না এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের চিরতরে মুসলিম সংখ্যাগুরুদের দয়ার উপর চলতে হবে।

যদিও কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া প্রস্তাবটি আলোর মুখ দেখা সম্ভব ছিলো না, বোস এবং সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গঠনতন্ত্র নিয়ে একটি মতৈক্যে পৌঁছুতে তাদের আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর মত বোসও বিশ্বাস করতেন যে, বিভক্তিকরণের ফলে বাংলার অর্থনীতি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং অর্ধেকের মত হিন্দু জনগোষ্ঠী অসহায় অবস্থায় পুর্ব পাকিস্তানে আটকা পরবে।

চুক্তিটি ২৪ মে,১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। চুক্তিটি আক্ষরিক অর্থে একটি রাজনৈতিক চুক্তি ছিলো এবং তৃণমূল পর্যায়ে বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। কেননা ছয় বছর ধরে মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্বের ক্রমাগত প্রচার; সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রণালয়ে হিন্দু ধর্মালম্বীদের প্রান্তিকীকরণ এবং ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার ফলে মুসলিম লীগের প্রতি বাঙালি হিন্দুদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস তখন সামান্যই অবশিষ্ট ছিলো।

এর মাঝেই নির্বাচকমণ্ডলীর প্রকৃতি প্রশ্নে (পৃথক বা যৌথ) বোস এবং সোহরাওয়ার্দীর মাঝে মতানৈক্য দেখা দেয় । সোহরাওয়ার্দী মুসলিম ও মুসলিম নন- তাদের জন্য পৃথক নির্বাচন বজায় রাখার উপর জোর দেন। কিন্তু বোস এর বিরোধিতা করেন। তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন কেননা কংগ্রেস এর দিক থেকে এবং অন্য কোন উল্লেখযোগ্য সমর্থনের অভাব ছিল। ফলে অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।

তারপরেও, এই পদক্ষেপকে বাংলার বিভক্তি এড়ানো এবং বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একত্রে বসবাস করার ইচ্ছার শেষ চেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

(গ) দেশভাগের প্রকৃত কারণ

বামপন্থীদের একটা অতিপ্রিয় বুলি হচ্ছে, দেশভাগ ইংরেজরা করেছিল | এই কথা যদি সত্যি হয় তাহলে মানেটা দাঁড়ায় যে ভারতে হিন্দু আর মুসলমান পরস্পর মিলেমিশে বাস করত | ইংরেজরা তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল এবং পরিনামে দেশভাগ হয়েছিল | কোনো কোনো বামাতি তো আবার এটাও বলে যে মিল সাহেব তাঁর ইতিহাসে প্রথম হিন্দু আর মুসলমানকে দুই পৃথক জাতি হিসেবে দেখিয়েছিলেন | ইটা তারা বলে আগের মতটাকে জাস্টিফাই করতে | ইংরেজরা কিভাবে ডিভাইড এন্ড রুল করেছিল তা দেখাতে | আমি এর বিরোধিতা করি |

আমার মতে দেশভাগের মূল কারণ ছিল ধর্ম | হিন্দু ও মুসলমান কোনকালেই মিলেমিশে থাকেনি | তারা দুই পৃথক জাতির মতই ছিল | ইংরেজদের কোনো দোষ নেই | তারা যেমনভাবে হিন্দু আর মুসলমানকে দেখেছিল, তেমনভাবেই তারা ইতিহাস লিখেছে | এই লেখায় আমি এইগুলি প্রমান করব |

এই লেখায় আমি দেখাবো যে ভারতে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে কতগুলি দাঙ্গা হয়েছিল, সেসব দাঙ্গার কারণ কি ছিল, ইংরেজরা হিন্দু আর মুসলমানকে কি চোখে দেখত এবং কেন |আরেকটা কথা | সবিনয়ে বলি যে ইতিহাসে লিখা থাকলেই কোনো কিছু সত্যি হয়ে যায় না আর লিখা না থাকলেই কোনো কিছু মিথ্যা হয়ে যায় না | যেসব দাঙ্গার কথা বলতে যাচ্ছি সেগুলো ইস্কুলের ইতিহাস বইতে লিখা নাই কিন্তু সত্য ঘটনা | এই তথ্যগুলি চেপে যাওয়া হয়েছে | উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবেই চেপে যাওয়া হয়েছে | যাতে করে দেশভাগের আসল কারণ আমরা কোনদিন বুঝতে না পারি | আসল কালপ্রিটকে জানতে না পারি | উদ্দেশ্য ১০০% সফল হয়েছে | আজ অব্দি সেই ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে আমরা সযত্নে বয়ে চলেছি যা দেশভাগের জন্য দায়ী |

সর্বপ্রথমে হিন্দু ও মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক | হিন্দু ও মুসলিম পরস্পর এই ভারতে লড়াই করেই এসেছে | দুজনের মধ্যে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক | দুই সম্প্রদায়ই পরস্পর বহু দাঙ্গা করেছে |

১৮৮৯ সালে দিল্লিতে এক হিন্দুর ধর্মান্তরকরণ নিয়ে দাঙ্গা বাঁধে | ১৮৯১ সালে কলকাতায় মসজিদ বানানো নিয়ে দাঙ্গা লাগে |ওই একই বছরে পলাকাদে হিন্দু ধর্মীয় মিছিলের উপর মুসলিম আক্রমন হয় | ১৮৯২ সালে প্রভাসপাতনে মহরম নিয়ে হিন্দুরা দাঙ্গা লাগায় | ১৮৯৫ সালে পোরবন্দর-এ হিন্দুর ঘরের পাশ দিয়ে মুসলিম ধর্মীয় মিছিল বেরোলে হিন্দুরা আক্রমন করে | এইরকম হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে বহু দাঙ্গা হয়েছে , তাদের বিবরণ নিচের লিঙ্কে পেয়ে যাবেন |

hindu muslim riots a survey

the riot torn history of hindu and muslim relationship

(হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা পরিস্থিতিতে কলকাতার রাস্তায় টহল দিচ্ছে ব্রিটিশ সৈন্য।)

দাঙ্গার তালিকা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে হিন্দুরা দাঙ্গা লাগাত গরু কাটা নিয়ে | আজও যেমন লাগায় | মুসলিমরা লাগাত মসজিদের সামনে গান বাজানো বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে | আরো অনেক কারণ আছে | আমি কয়েকটা বললাম |

ইংরেজরা এইসব দাঙ্গা প্রবন চরিত্র দেখে হিন্দু আর মুসলিমদের দুই পৃথক জাতি ভেবেছিল | ভাবাই স্বাভাবিক | এর সাথে যদি যুক্ত হয় ছোঁয়া ছুই-জল অচল-ছায়া মাড়ানো ধর্ম , তাহলে দুই জনকে দুই মেরুর বাসিন্দা বলে ভাবাটা কি খুব কষ্টকর ? মিল সাহেব এইসব দেখে হিন্দু ও মুসলমানকে দুই পৃথক জাতি বলেছেন | খারাপ বলেননি |

ইংরেজ আমলে দুই সমাজ সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে | হিন্দুরা বানায় হিন্দু মহাসভা আর মুসলিমরা বানায় মুসলিম লিগ | দুই দলেরই উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের তোষণ করে কিছু সাম্প্রদায়িক সুবিধা ভোগ করা | অর্থাত এখানেও সাম্প্রদায়িকতা চলে এলো | এই দুই দলই আগের মত পরস্পরের সাথে দাঙ্গা করত | দুই দলেরই উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় নিজেদের সম্প্রদায়ের হাতে ক্ষমতা নেয়া |

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের আর্থিক ক্ষতি হলে তারা ভারত স্বাধীন করার কথা ভাবতে থাকে | মুসলিম লিগ দেখে ক্ষমতা হিন্দুদের দিকে যাচ্ছে | তখন তারা দেশভাগের প্রস্তাব দিয়েছিল | হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা প্রবন চরিত্র দেখে ব্রিটিশরা বুঝতে পারে যে স্বাধীন হলে ভারতে সিভিল ওয়ার শুরু হয়ে যাবে | তাই তারা দেশভাগের সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়েছিল | এতে ব্রিটিশদের দোষ কোথায় ?

সুতরাং দেশভাগের জন্য দায়ী সংকীর্ণ ধর্মীয় আবেগ আর সাম্প্রদায়িকতা | ইংরেজরা কোনভাবেই দায়ী নয় | বামাতিরা মিথ্যা কথা বলে মুসলিম ভোট পাবার জন্য | আবার হিন্দু ও মুসলিমরা একে অন্যকে দোষারোপ করে | সেটাও সত্যি নয় | আসল কথা হলো তারা দুজনেই দায়ী | বা আরো ভালোভাবে বললে তাদের সংকীর্ণ ধর্মীয় আবেগ দায়ী |

(১৯৪৭ ট্র্যাজেডির অগ্রপশ্চাৎ

>১৯৪৭ সাল। ভারতবর্ষ থেকে পাততাড়ি গোটাল ব্রিটিশ উপনিবেশ। তিনটি খণ্ডে দুটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল অখণ্ড ভারত। ভাগ হলো বাংলা। অসংখ্য মানুষ আজন্মের ভিটামাটি ছেড়ে গেল নিজের নতুন দেশের খোঁজে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান—এই তিন রাষ্ট্রের সম্পর্ক ও পরবর্তী রাজনীতির বড় নিয়ামক হয়ে উঠল দেশভাগ। ৭০ বছর পর ফিরে দেখা

দেশভাগের ফলে পূর্ব বাংলা থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের পশ্চিমবঙ্গে যাত্রা। সৌজন্য: দ্য গার্ডিয়ান

আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি ট্র্যাজেডি খুবই ভয়ংকর: একটি ঘটেছে ১৮৫৭ সালে, আরেকটি ১৯৪৭-এ। একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত। মাঝখানে আছে স্বাধীনতাসংগ্রামের মহাকাব্য, কিন্তু সে সংগ্রামের পরিণতি মহাকাব্যিক হয়নি, হয়েছে ট্র্যাজিক। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টে যে ঘটনাটা ঘটল, আপাতদৃষ্টিতে তা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং পুরোপুরি অকল্পনীয়। কেউ ভাবেনি এমনটি ঘটবে। স্বাধীনতার নামে যে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস পাওয়া যাবে, এবং ভারতবর্ষ যে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো ডমিনিয়ন হয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভেতরেই রয়ে যাবে, এটা মোটামুটি জানা ছিল। কংগ্রেস ও লীগ এ ব্যাপারে সম্মত ছিল; কিন্তু দেশভাগ ঘটবে, বাংলা ও পাঞ্জাব দু-টুকরো হয়ে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অংশ হবে—এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
মুসলিম লীগ যা চেয়েছিল, সেটা হলো মুসলমানদের অন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি, তার জন্য যে দেশভাগ প্রয়োজন হবে, এটা তারা ভাবেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা যে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি ঢিলেঢালা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি ভৌগোলিক গ্রুপ তৈরির ধারণাটাকে গ্রহণ করেছিল, তার পেছনে এই বোধ কার্যকর ছিল, এর বেশি পাওয়া যাবে না। কংগ্রেস সেটা মানতে রাজি হয়নি। কারণ তাদের বক্তব্য ছিল, ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ; এবং তাকে কোনো রকমেই বিভাজিত করা চলবে না। তবে দুই পক্ষই আবার এই ব্যাপারে একমত ছিল যে প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যাবে না, রাষ্ট্র থাকবে এককেন্দ্রিক; বিরোধটা ছিল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা কীভাবে ভাগ করা যায়, তা নিয়ে। জওহরলাল নেহরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেউই প্রাদেশিক নেতা হতে চাননি, চেয়েছেন সর্বভারতীয় কর্তা হবেন।
ওই যে এক জাতির দেশ বলে দাবি করা—এর ভেতরেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের বীজ। কারণ এক জাতির দেশ বলার অর্থ দাঁড়িয়েছিল হিন্দুদের দেশ বলা। আসলে ভারতবর্ষ তো কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ; আর সে জাতীয়তার ভিত্তি ধর্ম নয়, ভাষা। সে হিসাবে ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষে একটি-দুটিও নয়, সতেরোটি জাতি ছিল। ভারতবর্ষের মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণির। কিন্তু কংগ্রেস ও লীগ কেউই শ্রেণি সমস্যার সমাধান চায়নি। দুই দলই ছিল বিত্তবানদের সংগঠন। তারা চেয়েছে ইংরেজ শাসকেরা তাদের কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে, এবং তারা গদিতে বসে পড়ে ঠিক সেভাবেই দেশ শাসন করবে, যেভাবে ইংরেজরা করেছে। শাসন মানে আগের মতোই দাঁড়াবে শোষণ। শ্রেণিবিভাজনের সমস্যা সমাধান করতে হলে সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল; সেটা কংগ্রেস ও লীগ কেউ চায়নি; ইংরেজরা তো চায়ইনি। ইংরেজরা চেয়েছে তাদের আনুকূল্যে তৈরি বিত্তবান তাঁবেদার শ্রেণির হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাবে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে।

দেশভাগ হয়েছে এই তিন পক্ষের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে। মেহনতি মানুষ এর ধারেকাছেও ছিল না। বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কংগ্রেস ও লীগের নেতাদের দর-কষাকষি চলেছে। জিন্নাহ ও নেহরুর সঙ্গে বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নেহরুর সঙ্গে তো সম্পর্কটা বন্ধুত্বের পর্যায়েই চলে গিয়েছিল। এই বন্ধুত্ব বড়লাটের স্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছিল। নেহরু-জিন্নাহর কলহটা ছিল পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার মতো। বাগ্বিতণ্ডা চলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই ভাই-ই মেনে নিলেন যে ক্ষমতার ভাগটা দেশভাগ ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটে গেল।
ক্ষতি বিত্তবানদের হয়নি। ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের। ঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, তবে ধারণা করা হয়, ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশত্যাগের ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ক্ষতিটা অপূরণীয়। সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব করা যায়নি, যাবেও না। অথচ মূল যে সমস্যা—যেটা হলো শ্রেণিবিভাজনের—তার কোনো সমাধান ঘটল না। ধনী-গরিবের পার্থক্য আগের মতোই রয়ে গেল। উন্নতি যা হলো তা বিত্তবানদের, সেই উন্নতির বাহক হয়ে থাকল মেহনতি মানুষ, আগে যেমন ছিল। শ্রেণি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা সমাজতন্ত্রীরা করেছিলেন। তাঁরা সংগ্রামে ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল দুই দিকের দুই জাতীয়তাবাদী দলের হাতে। যারা ছিল পুঁজিবাদে দীক্ষিত, এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী। বস্তুত দেশভাগে তড়িঘড়ি সম্মত হওয়ার পেছনে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তো ছিলই, আরও বড় করে ছিল সমাজবিপ্লবের ভয়। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার একটা মীমাংসা সম্ভব, কিন্তু বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটলে সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে—ছালা তো যাবেই, আমও হাতছাড়া হবে। অতএব যা পাওয়া যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ভালো। অস্পষ্টভাবে হলেও নেহরু-জিন্নাহরা জানতেন, ইংরেজের সঙ্গে দর-কষাকষি সম্ভব, কিন্তু মেহনতিরা উঠে এলে কোনো আলাপই চলবে না। তাঁরা জানতেন, ইংরেজ তাঁদের শত্রু বটে, তবে আরও বড় শত্রু হচ্ছে স্বদেশি মেহনতি মানুষ। এর প্রমাণ সুন্দরভাবে পাওয়া গেছে ‘স্বাধীনতা’র পরে। ভারতে কংগ্রেসবিরোধী মুসলিম লীগ নিষিদ্ধ হয়নি, যেমন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি লীগবিরোধী কংগ্রেস; কিন্তু উভয় রাষ্ট্রেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি।
শ্রেণি সমস্যা আড়াল করার জন্যই কিন্তু জাতি সমস্যাকে প্রধান করে তোলা হয়েছিল। এবং জাতীয়তার মূল ভিত্তি যে ভাষা, সেটাকে অস্বীকার করে ধর্মকে নিয়ে আসা হয়েছিল সামনে। ফলে সম্প্রদায় জাতি হয়ে গেল, জাতি রয়ে গেল আড়ালে। কংগ্রেস বলল, দেশটা এক জাতির, লীগ বলল, সেটা সত্য নয়, দেশ দুই জাতির। এক ও দুইয়ের হট্টগোলে সতেরো জাতি হারিয়ে গেল। কমিউনিস্ট পার্টি সতেরো জাতির কথা বলেছিল, কিন্তু কংগ্রেস ও লীগের যৌথ তৎপরতার কারণ ওই সত্যটিকে সামনে নিয়ে আসতে পারেনি।
বহু জাতিত্বের সত্যটাকে অস্বীকার করার পেছনে পরস্পরের শত্রু দুই দল এক হলো কেন? এক হলো এই জন্য যে দুই দলই ধর্মকে ব্যবহার করতে চেয়েছে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে। কংগ্রেস যতই নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করুক, তাদের ‘বন্দে মাতরম’ রণধ্বনি মুসলমানদের কাছে টানেনি, বরং ‘আল্লাহু আকবর’ আওয়াজ তুলতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ধর্মকে সামনে নিয়ে আসাতে আরও একটি সুবিধা হয়েছে। তা হলো মেহনতিদের শ্রেণি সচেতনতাকে ভোঁতা করে দেওয়া। গরিব হিন্দু ও গরিব মুসলমান যে ভাই ভাই এবং তারা উভয়েই যে ধনীদের দ্বারা শোষিত হচ্ছে—এই চেতনা যদি সজীব থাকে, তাহলে হিন্দু ধনী ও মুসলমান ধনী দুজনেরই বিপদ; তাই হিন্দু কংগ্রেস ও মুসলমানের মুসলিম লীগ দুই দলই মেহনতিদের তাদের গরিব পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান করে তুলতে চেয়েছে। এবং পেরেছেও। নইলে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হবে কেন? জাতি প্রশ্নের সমাধান জাতীয়তাবাদী দুই পক্ষের কোনো পক্ষই চায়নি। তাদের ভেতর অকথিত চুক্তি ছিল যে ধর্মের প্রশ্নটিকে তারা জিইয়ে রাখবে শ্রেণি প্রশ্নটি ঠেকানোর জন্য।
কংগ্রেস বলেছিল, ভারতকে খণ্ডিত করাটা তারা কিছুতেই মেনে নেবে না, মুসলিম লীগ বলেছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও বাংলার পুরোটাই তাদের চাই; তা সত্ত্বেও কংগ্রেস কেন দ্বিখণ্ডীকরণ মেনে নিল, মুসলিম লীগইবা কেন ‘কীট-দষ্ট’ পাকিস্তানে সম্মত হলো? নানা কারণের কথা আমরা জানি। যেমন কংগ্রেস ভাবছিল, লীগ যখন কিছুতেই তাদের দাবি ছাড়বে না, তখন কিছুটা ছাড় দিয়ে বড় অংশটা নিয়ে নেওয়া যাক। তা ছাড়া তাদের ধারণা ছিল যে খণ্ডিত বাংলা ও পাঞ্জাব নিজেরা টিকিয়ে রাখতে পারবে না, এবং ১০ কি ২০ বছর পরে ভারতের সঙ্গে স্বেচ্ছায় যুক্ত হয়ে যাবে। ভাগাভাগিটা তাই সাময়িক মাত্র। সম্মত হওয়ার পেছনে আরেকটি বিবেচনার কথাও জানা যায়, যা স্বয়ং নেহরু স্বীকার করেছেন। সেটা হলো, তাঁদের বয়স হয়ে যাচ্ছিল; এবং জেল খাটতে খাটতে তাঁরা ক্লান্ত বোধ করছিলেন। জিন্নাহকে অবশ্য জেল খাটাখাটনির বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি, কিন্তু বয়স তাঁরও হয়েছিল, এবং অন্যরা জানত না বটে, তবে তিনি জানতেন যে তাঁকে ক্ষয়রোগে ধরেছিল; যার দরুন হাতে বেশি সময় ছিল না নষ্ট করার মতো। কিন্তু মেহনতিদের অভ্যুত্থানের ভয়টা তাঁদের সবারই ছিল। সেটাই ছিল অস্বীকৃত চালিকাশক্তি।
অভ্যুত্থানের লক্ষণ তো দেখাও যাচ্ছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের প্রতি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ সমর্থন, নৌবিদ্রোহ, সামরিক বাহিনীর ভারতীয় সদস্যদের ভেতর অসন্তোষ, সর্বোপরি শ্রমিক ধর্মঘট ও কৃষক আন্দোলন এবং সেই সঙ্গে কমিউনিস্টদের শক্তিবৃদ্ধি—সবকিছুই বিপ্লবী অভ্যুত্থানের আভাস দিচ্ছিল। এই ধরনের অভ্যুত্থানের আশঙ্কাতে ইংরেজরাও উদ্বিগ্ন ছিল। স্মরণীয় যে ১৮৫৭-এর সিপাহি অভ্যুত্থান দেখে ইংরেজরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সিপাহি অভ্যুত্থানে মধ্যবিত্ত যে যোগ দেয়নি, এটা ছিল ইংরেজদের জন্য একটা বড় ভরসা; ভবিষ্যতের কোনো অভ্যুত্থানে যদি মধ্যবিত্তের বিক্ষোভ মেহনতিদের বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, তাহলে তাকে দমন করা যে সম্ভব হবে না—এটা তারা বুঝে নিয়েছিল। তাই তাদের চেষ্টা ছিল কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও মধ্যবিত্তকে আরও কাছে টেনে নেওয়া। এর জন্যই কংগ্রেস গঠনে উৎসাহদানে তারা আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। মধ্যবিত্তের একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থাকবে, সেখানে তারা অভাব-অভিযোগের কথা বলবে এবং আবেদন-নিবেদন করবে, অর্থাৎ ‘স্টিম’ ছাড়তে পারবে। মেহনতিদের সঙ্গে মধ্যবিত্তের শ্রেণিগত দূরত্বকে আরও গভীর করার লক্ষ্যেই মধ্যবিত্তকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গড়তে উৎসাহিত করা হয়েছিল। তবে শ্রেণিবিভাজনের চেয়েও বেশি ভরসা ছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ওপর। কেননা ধর্মীয় উন্মাদনা অন্য চেতনাকে কমিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে, এবং ওই উন্মাদনা পারে না এমন কাজ নেই। ধর্মীয় বিভাজনকে উসকে দিয়ে ভাগ করো ও শাসন করো নীতির বাস্তবায়নের চেষ্টা চতুর ইংরেজ শুরু থেকেই করে এসেছে। সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়ায় তারা প্রথমে কংগ্রেসের এবং পরে মুসলিম লীগ গঠনের উৎসাহ জোগাল। সেন্সাস রিপোর্টে হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করে দেখানোটা আগেই শুরু করেছিল, পরে আনল পৃথক নির্বাচন। হিন্দুরা ছিল প্রতিষ্ঠিত, মুসলমানরা ছিল উঠতি—এই দুইয়ের বৈষয়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সাম্প্রদায়িক রূপদানে ইংরেজের তৎপরতা বাড়তেই থাকল। উল্লেখ্য, ইংরেজাগমনের আগে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক পার্থক্য ছিল বটে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়েছে ইংরেজাগমনের পরে এবং তাদের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ উসকানিতে। সাম্প্রদায়িকতার এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। ধর্মকে কংগ্রেস ও লীগ উভয়েই ব্যবহার করেছে, এবং ইংরেজ তাতে হাওয়া দিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা শেষ পর্যন্ত রূপ নিয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার, এবং সিদ্ধান্ত দাঁড়িয়েছে—দেশভাগ ছাড়া গত্যন্তর নেই।

(১৯৪৭ সালের দেশভাগের চার কুশীলব (বাঁ থেকে) জওহরলাল নেহরু, সিরিল র‍্যাডক্লিফ, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ছবি: সংগৃহীত।)

প্রশ্ন ওঠে, এর দায়-দায়িত্ব কার কতটা? দৃশ্যমান দায়িত্ব কংগ্রেস ও লীগের। কংগ্রেসেরই অধিক, কারণ তাদের এক জাতিতত্ত্বের কারণেই দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভব সম্ভব হয়েছে; কংগ্রেস অবশ্য বলবে যে স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবি লীগই তুলেছিল। আসলে লীগের দাবিটা ক্রিয়া নয়, প্রতিক্রিয়া বটে। তবে কাজের আসল কাজি কংগ্রেস নয়, লীগও নয়; সে হচ্ছে ইংরেজ শাসক। ওই শাসকই সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে এবং মীরজাফর ও উমিচাঁদের রাজনৈতিক বংশধরদের উৎসাহিত করেছে নিজেদের স্বার্থে দেশবাসীকে সাম্প্রদায়িকভাবে ভাগ করে ফেলতে।
ভাগ তো হলো, কিন্তু তাতে জাতি সমস্যার সমাধান হলো কি? হলো না। পাকিস্তানে তো হওয়ার কথাই নয়, কারণ পাকিস্তানি জাতি বলতে কোনো জিনিসের অস্তিত্বই ছিল না; ছিল বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ ও পাঠান—এই পাঁচ জাতি। ঐতিহাসিক কারণে পাঞ্জাবিরা আধিপত্য করেছে। পাকিস্তানি জাতীয়তা গড়ে তোলার জন্য জিন্নাহ সাহেব উর্দু ভাষায় সাহায্য নেবেন ভেবেছিলেন; সুবিধা হচ্ছে না দেখে ফেরত গিয়েছিলেন ধর্মের কাছেই। ভারতে এখন ২২টি স্বীকৃত ভাষাভিত্তিক জাতি আছে, মতাদর্শিকভাবে তাদের এক রাখার উপায় কী? অন্য উপায় না পেয়ে ভারতীয় শাসকেরাও ধর্মের কাছেই ফিরে গেছেন। কথা ছিল ভারত হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, কিন্তু হিন্দুত্ববাদের বর্তমান তৎপরতা ধর্মনিরপেক্ষতাকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে। পাকিস্তান তো এখনো ধর্মের দোহাই পাড়ছে।
এমনকি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সেখানেও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আপস করতে হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সঙ্গে। কারণ কী? কারণটা পুরোনো। শ্রেণিচেতনাকে বিকশিত হতে না দেওয়ার বাসনা। রাশিয়ায় বিপ্লব হয়েছে, চীনে বিপ্লব হয়েছে, ভারতবর্ষে কেন হলো না? তার একটা কারণ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। ওই ব্যবহারে দেশভাগ সম্ভব হয়েছে। এবং একই পদ্ধতিতে এখনো চেষ্টা চলছে সমাজ বিপ্লবকে প্রতিহত করার। জাতি সমস্যার সমাধান করতে না পারার দরুন পাকিস্তানও টিকবে না, এবং ভারত যে ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দিয়ে জাতি সমস্যা ও শ্রেণি সমস্যা উভয়কেই বিলুপ্ত করে দেবে বলে আশা করছে, তা-ও করা সম্ভব হবে না।
বলছিলাম দেশভাগটা ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সিরিল র্যাডক্লিফের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে দেওয়ার। কাজটা তিনি করেছেন ম্যাপের ওপর পেনসিল দিয়ে দাগ কেটে। যদি অকুস্থলে যেতেন তবে পারতেন না, কারণ যথার্থ অর্থে ভাগ করা ছিল অসম্ভব কাজ। ১৩ আগস্ট গোঁজামিল দিয়ে কাজটা শেষ করে তিনি আর বিলম্ব করেননি। পারিশ্রমিকের জন্যও অপেক্ষা করার সময় হয়নি তাঁর, দ্রুত চলে গেছেন। অনুমান করেছিলেন প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ, কিন্তু সেটা কোন মাত্রায় গিয়ে পৌঁছাবে, তিনি হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি।
বাংলায় তো গৃহস্থের রান্নাঘর চলে গেছে হিন্দুস্থানে, শোয়ার ঘর পড়েছে পাকিস্তানে। বাংলা হচ্ছে নদীর দেশ। প্রায় সব নদী ওপর থেকে নিচে নেমেছে। নদীকে তো কাটা যায় না, তবু কাটা হয়েছে, এবং তাতেই বোঝা গেছে কেমন অবাস্তব ছিল ঘটনাটা। ভাটি তো শুকিয়ে মরে উজানকে না পেলে, উজান তো প্লাবিত হবে ভাটিতে নামতে না পারলে; দশা হয়েছে সেই রকম। ভাটিরই কষ্ট বেশি, কারণ উজান পানি ছেড়ে দেয়, প্লাবনের কালে।
শ্রেণি সমস্যার সমাধান তো হলোই না, জাতি সমস্যারও নয়। সমাধান হতে পারত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটার নেতৃত্ব যদি সমাজতন্ত্রীদের হাতে থাকত। সেটা ঘটেনি। অবিশ্বাস্য দেশভাগে লাভ যে হয়নি, তা নয়। হয়েছে। তবে সেটা সুবিধাভোগীদের, মেহনতিদের ভাগ্যে বাঞ্চনাই সত্য হয়ে রয়েছে। এপারে যেমন, ওপারেও তেমনই।

সূত্রঃ

বাংলা ভাগ ও মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল
লেখক – জগদীশচন্দ্র রায় 09969368536

- উইকিপিডিয়া

-মুক্তমনা বাংলা ব্লগ - বিজ্ঞান, যুক্তি, মুক্তচিন্তা

No comments

Powered by Blogger.