(ইহা একটি "এপিক" উত্তর হবে আশা করি)
চিঠিতে চিঠিতে যুদ্ধের ঝনঝনানি
বর্তমানের ন্যায় পূর্বে রাজা-বাদশাহরা দ্রুত তথ্য বিনিময় করতে পারত না। তাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল "চিঠি-বিনিময়"। আজ আপনাদেরকে জানাব ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য চিঠি চালাচালির ঘটনা, যেসব পত্রালাপে পরিলক্ষিত হয় অসম্ভব উত্তেজনাকর ও উত্তপ্ত বাক্যের সাথে সুন্দর বাচনভঙ্গি!
বলছি আঙ্কারার যুদ্ধের কথা, এই যুদ্ধ সংঘটিত হবার পূর্বে যুদ্ধের দুই অংশগ্রহণকারীদের নেতারা পরষ্পরের সাথে তীব্র বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন—চিঠিতে! কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনায় চলে যাই।
এই যুদ্ধের একপক্ষে ছিল অটোমান সাম্রাজ্য ও অন্যদিকে তৈমুরি সাম্রাজ্য।
তুর্কি-মঙ্গল শাসক তৈমুর লং-য়ের সাথে তৎকালীন অটোমান সুলতান বায়োজিদের পত্রালাপ ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যার জের ধরেই শুরু হয় আঙ্কারার যুদ্ধ।
ঐ সময়ে তৈমুরি ও অটোমান উভয় সাম্রাজ্যই বেশ দ্রুত বিস্তার লাভ করছিল। এই দুটি সাম্রাজ্যকেই তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে দুটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। ক্রুসেডারদের পরাস্ত করাসহ বায়োজিদ কম সময়েই ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ায় নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তিনি নিজেকে বায়োজিদ ঈলদিরিম অর্থাৎ বজ্রপাতের বায়োজিদ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। অন্যদিকে তৈমুর ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা দিগ্বিজয়কারী।
অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান বায়োজিদ, সুলতান-ই-রোম (রোমের সুলতান)
আমির তৈমুর, সহিব-ই-কিরান ( সৌভাগ্যবান একত্রীকরণের প্রভু)
কালক্রমে, এই দুই দ্রুতবর্ধনশীল সাম্রাজ্য একে অপরের সীমানার দ্বারপ্রান্তে এসে গেল। তৈমুরি ও অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ দানাবাঁধার শঙ্কা দেখা গেল। ইতিমধ্যেই বায়োজিদ এক পাশ্ববর্তী অঞ্চলের শাসকের কাছে সম্মানী/রাজস্ব দাবি করলেন যে কিনা আবার তৈমুরের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। বায়োজিদের এহেন আচরণ তৈমুরকে ক্ষুদ্ধ করল। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেল যখন বায়োজিদ তৈমুরের রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা তার শত্রুদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করলেন। এর মধ্যে প্রধান দুজন ছিলেন বাগদাদের সুলতান আহমাদ ও এক তুর্কিনেতা কারা ইউসুফ। তৈমুর বায়োজিদের নিকট উত্তপ্ত বাক্যে লিপিবদ্ধ চিঠি পাঠালেন এবং বায়োজিদও তার প্রত্যুত্তরে চিঠি প্রেরণ করতে থাকলেন। এই দুইয়ের পত্রালাপ, কথপোকথন ছিল ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য "কর্কশ কথপোকথন"।
"যেহেতু আমাদের নিকট সংবাদ এসেছে যে আপনাদের অধিপতি ইউরোপের কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখছে, আমরা কখনোই আমাদের সৈন্যদের তাই আপনাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিনি, ধ্বংস করতে চাইনি একটি মুসলিম রাষ্ট্রকে যা কেবলই আনন্দিত করত কাফেরদের। কিন্তু আমরা যখন শুনি আপনারা আশ্রয় প্রদান করেছেন কারা ইউসুফ তুর্কোমানকে, তখন এর চেয়ে আমাদের জন্য আপত্তিকর কিছু আর হতে পারেনা৷ এই ক্বারা ইউসুফ, পৃথিবীর বুকে বেচে থাকা নিকৃষ্ট ডাকাত ও খলনায়ক, বণিকদের মাল লুটপাট, ভ্রমণকারীদের হত্যা করাসহ আরও অসংখ্য অপরাধের নেতৃত্বদানকারী সে। সবথেকে আফসোসর কথা এই নিকৃষ্ট জীব বাস করে একটি মুসলিম দেশের মধ্যেই, যেখানে সে ঠিক কতগুলো ভেড়ার মধ্যে হিংস্র একটি নেকড়ের ন্যায়।"
— অটোমান দূতকে তৈমুর লং
এখানে পুরো চিঠি থেকে আরও মজাদার অংশ তুলে ধরে হলোঃ
"আল্লাহ আপনাকে যা দিয়েছেন এবং কাফেরদের থেকে যা ছিনিয়ে এনেছেন তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন কিন্তু এর বাইরে অন্যান্য শাসকদের কাছ থেকে যে প্রদেশ চুরি করেছেন তা ফিরিয়ে দিন এতে করে আল্লাহ আপনার উপর দয়াশীল হবেন। যদি না করেন তবে আল্লাহর সহায়তায় আমি হব অপ্রতিরুদ্ধ প্রতিশোধপরায়ণ!"
—তৈমুর লং
"আপনার অজস্র সৈন্য আছে;তাতে আমার কি আসে যায়;কিন্তু আপনার ওই রুগ্ন তাতারদের তীর-বল্লা আমার তলোয়ারবাজ ও অদম্য জেনিসারিদের কোদালের কাছে কিছুই না। যে রাজপুত্র আমার আশ্রয় প্রার্থনা করেছে তাকে আমি অবশ্যই রক্ষা করব, পারলে যুদ্ধের ময়দানের তাবুতে খুজে নিবেন।"
—বায়োজিদ
"যেহেতু আপনার অগাধ উচ্চাকাঙ্ক্ষার লালিত-পালিত জাহাজ ইতিমধ্যেই আপনার স্বার্থপরতায় রসাতলে গেছে....আপনার উচিত হবে এখনি হঠকারিতার পাল নামিয়ে, অনুতাপের নোঙ্গর সততার বন্দরে গেঁথে দেওয়া—যেটি একই সাথে নিরাপদ বন্দরও বটে; নতুবা আমাদের প্রতিহিংসার আগুনে আপনি জ্বলে-পুড়ে মরবেন যেটা আপনার প্রাপ্য।"
—তৈমুর লং
"সময় থাকতে সুবুদ্ধি লাভ করুন এটাই প্রার্থনা করি;বুঝার চেষ্টা করুন এবং আমাদের প্রতিহিংসার পাত্র হওয়া থেকে এড়িয়ে চলুন নতুবা আমাদের শক্তির মোকাবেলা করতে হবে আপনাকে।হায়রে যারা পিপড়ার থেকে বেশি কিছু নয়, কেন হাতিকে জ্বালাতন করতে আসে! তারাতো হাতির পায়ের তলায় পিষে মরবে! "
—তৈমুর লং
"তৈমুর নামের অহংকারী বজ্জাত, এটা জেনে রাখুন, আপনি তো রাজা তেফকুরের চেয়েও কাফের, অভিশপ্ত ব্যাক্তি শুনে রাখুন আমরা আপনার পত্র পড়ি। আপনি কি আমাকে পারস্যের রাজার মতো ভাবেন কিংবা প্রান্তের বর্বর তাতারদের ন্যায়, নাকি ভারতের মতো নামেমাত্র সৈন্যদের অধিপতি, নাকি ইরাক ও হেরাতের রাজাদের মতো যাদের আদৌ নেই কোন শৃঙ্খলা? নাকি আপনি মনে করেন সিরিয়ার আলেপ্পোর সৈন্যদের মতোই আমার ভান্ডারে নেই কোন গাজী, নেই কোন মুসলিম সাহসী বীর? আপনি এই সমস্ত জায়গায় কত অনাচার করেছেন তা আমি জানি, আমরা সবাই জানি-'যে আল্লাহর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, তার ধ্বংস অনিবার্য'। আপনি কেবল পারার মধ্যে পারেন রক্ত ঝরাতে, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে এবং নারীদের সম্মানহানি করতে। আমি অল্প কথায় শেষ করব, অটোমানদের গুরুদায়িত্ব হচ্ছে কাফেরদের মোকাবিলা করা; ইসলামের শত্রুদের ধ্বংস করা। আমি যদি আপনার মোকাবিলা না করি আমার বিবিরা যেন আমায় তালাক দেয় এবং আপনি যদি যুদ্ধ অপারগতা প্রকাশ করেন তাহলে যেন আপনার বিবিরা পরপুরুষের হয়ে যায়। সকল মুসলিমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ হাশরের দিনের আগ পর্যন্ত আপনার ও আপনার অনুসারীদের উপর গযব নাযিল করুক।"
—বায়োজিদ
তৈমুরের সিলমোহর
বায়োজিদের চূড়ান্ত বার্তা তৈমুরের ধৈর্য্যের জন্য একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে নারীর (অন্য পুরুষের রমনীর গায়ে হাত দেওয়া) প্রসঙ্গ আনাটা ছিল চাগাতাইদের জন্য খুবই অপমানজনক যার যথার্থ প্রত্যুত্তর কেবল রক্ত দিয়েই দেওয়া যায়। তৈমুর বিভিন্ন স্থান থেকে তার সৈন্যবাহিনী জড় করলেন ও পশ্চিমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
"উসমানের বংশধর পাগল হয়ে গেছে" —তৈমুর
এই পুরো ব্যাপারের নিষ্পত্তি হবে আঙ্কারার যুদ্ধে, ২০ জুলাই ১৪০২ ইংরেজ সন। দুই পক্ষের সেনাবাহিনী পরষ্পরের মুখোমুখি হবে কিন্তু দিন শেষে জয় পায় তৈমুরের বাহিনী! এই বিজয় তৈমুরের ইতিমধ্যেই গড়া বর্ণাঢ্য জীবনবৃত্তান্তে আরেকটি সাফল্য যোগ করল। অটোমানরা শুধু হেরেছিল তাই না, তৈমুর তার রাজ্যে বায়োজিদ ও তার দুই পুত্রকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইতিহাসে এই কেবলমাত্র একটি সময়েই অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরব কার্যত ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল।
No comments