একেবারে শেষের অংশের উত্তরটা আগে দেই। বাঙালি "জাতিতত্ত্ব" একটি রাজনৈতিক ধারণা। যা এখনও সম্পূর্ণ গঠিত হয়নি। তবে যা তৈরী হয়েছে তা হচ্ছে বাঙালি জাতিসত্বা। কীভাবে তৈরি হলো তার একটা উত্তর রাজনৈতিক ইতিহাসের তুলনায় বরং জেনেটিকালি ও এনথ্রোপলজিকালি দেয়া বোধহয় সবথেকে সঠিক হবে। সেই চেষ্টাটা করছি-
জেনেটিক জরিপের মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে টাটা মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটের ডঃ ভি বালাকৃষ্ণান তাঁর "A Preliminary Study of Genetic Distances among Some Populations of the Indian Sub-continent" প্রবন্ধে দেখান যে বাঙলা সংলগ্ন ভূখন্ডের জনগোষ্ঠী মূলত আদি-আস্ট্রেলিয় ও মঙ্গোলয়েড মিশ্রণে গঠিত এবং জেনেটিক বৈচিত্রের দিক থেকে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে সবথেকে বৈচিত্রময় এবং সেখানে আর্য/ইউরোপয়েড প্রাধান্য নেই বললেই চলে। সহজ করে বললে বলা যায়, নানাবিধ শংকরায়ন সত্ত্বেও সরলার্থে- বাঙালি জাতির গাঠনিক পূর্বপুরুষেরা এসেছেন মূলত আদি-অস্ট্রেলিয়া ভূখন্ডের আদিবাসীদের সাথে আদি-মোঙ্গলদের একটি অসম সংকরের মাধ্যমে। জেনেটিকালি ডঃ বালাকৃষ্ণান এও দেখাতে সক্ষম হন যে, বাঙালি মুসলমানদের সাথেও ভারতের অপরাপর ১৭ টি মুসলমান জনগোষ্ঠীর জেনেটিক কোন মিল নেই। অর্থাৎ, বাঙালি মুসলমানরা আসলে বাঙালি হিন্দুদের থেকে মোটেই ভিন্ন কোনো জাতি নয়। হিন্দু-মুসলমান, পূর্ব-পশ্চিম নির্বিশেষেই বাঙালিরা একই জাতি।
জেনেটিক বিজ্ঞানের প্রসারের পূর্বে এনথ্রোপলজিস্টগণও (নৃবিজ্ঞানী), শারিরীক গঠণ ও মাথার খুলির আকৃতির উপর নির্ভর করে প্রায় একই ধরণের উপসঙহারেই পৌঁছেছিলেন। প্রফেসর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ বিষদ বৈজ্ঞানিক প্রমানের মাধ্যমে বাঙালির রক্ত-সাংকর্যের (শংকরায়ন) মধ্যে অস্ট্রালয়েড ও মঙ্গোলয়েড প্রাধান্য নৃতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেন। এরও বেশ আগে প্রফেসর নীহাররঞ্জন রায়ও তাঁর "বাঙ্গালির ইতিহাস (আদিপর্ব)" নামক গবেষণা গ্রন্থে একই বিশ্লেষণ দেখিয়েছিলেন।
এই গেলো শেষ অংশের পুরো উত্তর। এবার প্রশ্নটির প্রথম অংশের ব্যাপারে কিছুটা বলি-
"বাংলাদেশ" বলতে কেবলমাত্র পূর্ব-বঙ্গ বোঝার যে প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিকভাবে চলমান, তা মূলত ১৯৪৭ এর অগাস্ট মাসের কিছুদিন আগ পর্যন্তও অনুপস্থিত ছিলো। বিভাগপূর্ব অসংখ্য সাহিত্যিক, কবি, লেখক,গবেষকের কথায় বাংলাদেশ বলতে মূলত সমগ্র বাংলাকেই বুঝানো হতো। যেমন, সুকান্ত, নজরুল, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায় ইত্যাদি! এমনকি রাজনীতির মানুষেরাও তেমনটাই ভাবতেন। উদাহরণ হিসেবে বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান'এর "অসমাপ্ত আত্মজীবনী"র উল্লেখ করা যায়। যেখানে ৪৭ পূর্ব সম্পূর্ণ অংশে উনি সমগ্র বাংলা বুঝাতেই "বাংলাদেশ" শব্দটি উল্লেখ করেছেন; এমনকি যখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র হিসেবে উনি তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবরণ দিচ্ছেন তখনও ওনার মধ্যে বাংলাদেশ বলতে কেবলমাত্র পূর্ব-বঙ্গ বোঝানোর কোনোপ্রকার চেষ্টাই অনুপস্থিত। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষদের উৎস বলতে কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গের বাঙালির ইতিহাস বুঝতে চাওয়া হলে তা বাঙলা'র দীর্ঘ ইতিহাসের অপলাপ হবে। এজন্যই প্রশ্নটির শেষ অংশের উত্তর প্রথমে দেয়ার চেষ্টা করেছি- আমার ধারণা মূল প্রশ্নটিও সেটি।
ধন্যবাদ।
[সংযুক্তিঃ বাঙালির জাতিগত আত্মপরিচয়ের উত্তর খোঁজার জন্য আধুনিক জিনবিজ্ঞান আরো দারুণ সব পসরা সাজিয়েছে। বাঙালির জিনগত উদ্ভবের ইতিহাস নিয়ে সর্বশেষ গবেষণা হয়েছে সেই আশির দশকে। বর্তমান সময়ের উচ্চতর জিনবিজ্ঞান বাঙালির জিনের গড়পড়তা কতখানি অংশ অস্ট্রালয়েড, কতখানি মঙ্গোলয়েড, কতখানি নেগ্রীড (আফ্রিকান) আর কতখানি আর্য(ইউরোপয়েড) তার প্রায় নির্ভূল হিসেব দিতে পারে। সেই সাথে জিন-ডেটিং এর মাধ্যমে এগুলোর কোন অংশ ইতিহাসের কোন যুগে বাঙালির রক্তে প্রবেশ করেছিলো তারও প্রায় নির্ভূল উত্তর দিতে পারে। বর্তমানে বাঙালি জিনবিদরা নিজেদের কাঁধে এই দায়িত্বটি একদিন তুলে নেবেন সেই আশা প্রকাশ করছি।]
No comments