Header Ads

Header ADS

ইরানের গোয়েন্দা সক্ষমতা কি এতটাই দুর্বল যে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ? দেশের অন্যতম শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যার প্রতিবাদে ইরান কী করতে পারে?

মহসিন ফখরিজাদাহ কেবল ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীই ছিলেন না তিনি একাধারে ইসলামিক রেভুলোশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ছিলেন। স্বভাবতই জনমনে প্রশ্ন উঠে এরকম একজন ব্যাক্তিকে ইরান কেন হালকা নিরাপত্তা প্রদান করেছে?

কাশেম সোলাইমানির ন্যায় সম্ভবত তিনিও ভারী নিরাপত্তা নিয়ে চলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না—এটা আমার ব্যাক্তিগত অনুমান কেননা শোনা যায় কাশেম সোলায়মানির সাথে তার বেশ অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিল, দুইজনই লো প্রোফাইল বজায় রাখতেন ও বর্ণাঢ্য আয়োজন পছন্দ করতেন না । কিন্তু মহসেন কি সোলায়মানির মৃত্যুর পরও নিজে থেকে আরও সচেতন হননি? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা হয়তো কখনও জানব না।

ইরানে একযুগে দশজনের অধিক বৈজ্ঞানিক গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। ইরান তার পরমাণু কর্মসূচীর অনেক গোপন তথ্য সিআইএ ও মোসাদের নিকট পাচার করছে সন্দেহে এমন অনেক বৈজ্ঞানিক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাজাও দিয়েছে। যদি এমনটাও ভাবি যে মহসেন ফখরিজাদেহ হয়ত মোড় ঘুরিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে কাজ করছিলেন, তাকে অন্যপথে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ইরানই নিজে এই নাটক সাজিয়েছে, তাহলেও আসলে কোন সঠিক চিত্র দাড় করানো সম্ভব নয়। কেননা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অতীতের ক্লিন রেকর্ড ইহা সমর্থন করেনা।

আমার এহেন ভাবনার কারণ এই নিচের চিত্রটি—

এখানে ম্যাপে হামলার স্থানটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে

আবসার্ডের রাস্তা ও ফিরুজকুহের মেইন রাস্তার একেবারে সংযোগস্থলেই হামলাটি হয়েছে বলা যায়। এই স্থানটি রাজধানী তেহরানের পূর্ব দিকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত বা বলা যায় রাজধানী তেহরানের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই পড়ে স্থানটি। ইরানের নিরাপত্তা বলয়ের এত গভীরে ইসরায়েলি গুপ্তচররা হামলা চালালো এত সহজেই? হ্যাঁ, মোসাদ ও এর আরব গুপ্তচররা হচ্ছে ব্যাডএস, অনেক ঝুকিপূর্ণ কাজও তারা বেশ নিখুতভাবে সম্পন্ন করতে পারে। কিন্তু এরকম প্রকাশ্যে আততায়ীদের হামলা ইরানের মাটিতে! তাও আবার রাজধানী তেহরানেই! তাছাড়া মনে রাখতে হবে কোন কারণে তিনি যদি ইসরায়েলের কাছে আত্মসমর্পণ করতেন ইরানের বাড়োটা বেজে যেত, তিনি নিঃসন্দেহে ইরানের পরমাণু অস্ত্র প্রোগ্রামের পুন-পুনশ্চ খবর জানেন৷ ইসরায়েলে তাকে ব্যবহার করে ইরানের যতটুকু গ্রহণযোগ্যতা আছে তাও শেষ করে দিতে পারত। আমি মনে করি Defection এর জন্য তাকে অনেক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ইসরায়েলের পক্ষ থেকে।

তবে আততায়ীরা ইসরায়েলি ছিল না। হামলার বর্ণণা কিছুটা এরকমঃ মহসিনের গাড়ি আবসার্ডের রাস্তায় আসার সাথেসাথেই মেশিনগান ও গাড়িবিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল, গাড়িতে থাকা বডিগার্ডরা আক্রমণকারীদের উপর পাল্টা আক্রমণ করলেও মহসিনসহ তার সাথে গাড়িতে থাকা অন্যান্য দুই-তিনজন আরোহী মারাত্মকভাবে আহত হন। হাসপাতালে নিলে সবাই মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু বডিগার্ডদের কেউ নিহত হয়েছেন কিনা তা কোন সংবাদপত্রের স্পষ্ট কর বলেনি। তিন-চারজন হামলাকারীদের সবাই ঐ স্থানেই নিহত হয়েছেন।

কেন জানি এই বর্ণনা অদ্ভুত লাগছে। এটা কি আততায়ীদের সুইসাইডাল মিশন ছিল? সম্ভবত হামলা আরও সিনেমাটিক কায়দায় হয়েছিল, ইরান কর্তৃপক্ষ শত্রুপক্ষের চতুরতার গুণগান গাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্যই স্পষ্ট বর্ণনা প্রদান করেনি।

নিচের চিত্রের এই গাড়িটিকে দেখেও বুলেটপ্রুফ মনে হয়না

একটা জিনিস খেয়াল করুন, গাড়ির ফ্রন্টে গ্লাস ব্যাতীত অন্যান্য জায়গায় বুলেটের আঘাত নেই বললেই চলে, হামলাকারীদের হাতের নিশানা ভালো ছিল বলতে হবে। আচ্ছা যদি হত্যাকারীরা ট্রাক উঠিয়ে দিত তাহলে কাজটা আরো সহজে করা যেত? ঠিক না? কেন জানি আমার সবকিছু সাজানো মনে হচ্ছে।

মহসিন ফখরিজাদাহ ১৯৮৯ সালে ইরানের পরমাণু অস্ত্র প্রজেক্ট আমাড শুরু করেন, কিন্তু বর্হিবিশ্বের চাপে ২০০৩ সালে প্রজেক্ট আমাড বাতিল করা হয়। ধারণা করা হয় ইরানের পারমানবিক অস্ত্রের প্রজেক্টে তিনি একাই যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন৷ ২০০৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস তাকে আমেরিকার ম্যানহাটন নিউক্লিয়ার ওয়েপন প্রজেক্টের অন্যতম পুরোধা রবার্ট জে. অপ্পেনহেইনারের সাথে তুলনা করে। আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার ওয়েপন ওয়াচডগের মতে তিনিই ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের মূল কারিগর, এক্ষেত্রে ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হলে তাকে ফাদার অফ নিউক্লিয়ার ওয়েপন উপাধি দেওয়া হত।

টুইটার থেকে সংগ্রহিত মহসিন ফখরিজাদাহের শেষ মূহুর্তের একটি ছবি

ইসরায়েল তাকে অনেক আগে থেকেই চিনত। ২০১৭-২০১৮ সালে ইসরায়েল বেশ কয়েকবার ইরানের পারমাণবিক গবেষণারে গুপ্ত অভিযান চালায়। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা সেখান থেকে পারমাণবিক অস্ত্রের মডেল ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের যথেষ্ট প্রমাণ পায় বলে দাবি করে ইসরায়েল। তেলআবিবের একটি রিপোর্টে দাবি করা হয় ইসরায়েলি গোয়েন্দারা পঞ্চাশ হাজার পৃষ্ঠার দলিলপত্র ও ১৬৩ টি ডিস্ক, মেমস চুরি করে। এগুলো নিয়ে পরে ইসরায়েল আমেরিকা ও ইসরায়েলি সাংবাদিকদের সামনে ব্রিফিং করেছিল, যদিও বেশিরভাগ কাগজপত্র ছিল পনের বছর আগের। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা দাবি করেন বেশকিছু সাম্প্রতিক ডাটাও তাদের কাছে কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে সেগুলো সাংবাদিকদের নিকট পেশ করা যাবে না। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এসব তথ্য ট্রাম্পের নিকট তুলে ধরলে ট্রাম্পের ইরান নিউক্লিয়ার চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা শেষপর্যন্ত বাস্তবে রূপ নেয়। উল্লেখ্য এই অপারেশনে মোসাদ ও তার আরব গুপ্তচর উভয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, ওই রিপোর্টে আরও বলা হয় সকাল ৭ টার আগেই মোসাদের সদস্যদের ইসরায়েলে ফিরে আসার আদেশ ছিল। কেউ চাইলে পুরো রিপোর্টটা পড়তে পারেন, এই লিংকে প্রবেশ করুন https://www.nytimes.com/2018/07/15/us/politics/iran-israel-mossad-nuclear.html

উপরে প্রথম চিত্রে সাংবাদিকদের সামনে ইরানের কুকীর্তি বর্ণনা করছেন নেতানিয়াহু, তিনি মহসিনকে প্রধাণ কালপ্রিট হিসবে বর্ণনা করেন। দ্বিতীয় চিত্রে ইরানের পরমানু গবেষণাগার থেকে ইসরায়েলি গুপ্তচরদের তোলা ছবি। ইউএস ও ব্রিটেন ইসরায়েলের প্রমাণাদি বেশ ভালোভাবে হজম করেছিল

সুতরাং পূর্বের ন্যায় এখনো সরাসরি নিজস্ব লোক ব্যবহার করেই অপারেশনের সংস্কৃতি চালু আছে। তবে মোসাদের সদস্যদের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি বেশ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, ইতিহাসে মোসাদের গুপ্তচর ধরা পড়েছে বা হত্যার শিকার হয়েছে এরকম দৃষ্টান্ত তেমন নাই। সুইসাইডাল মিশনগুলো তারা তাদের আরব চামচাদের দিয়ে করায়। মহসিনের ক্ষেত্রেও তেমনটা দেখা যায়। তবুও একজন আততায়ীদেরও জীবিত ধরতে না পারাটা বেশ অদ্ভুদ। আমার কেন জানি মনে হয় ধর্মীয় আদর্শগত কারণে ক্ষোভ আছে এমন আরব গোষ্ঠীকে এই কাজের জন্য ভাড়া করেছে মোসাদ, এসব আরব গোষ্ঠী/সংগঠনের সদস্যরা নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিতে মোটেও দ্বিধা করবে না।

আমি এটাও মনে করি ইরানের আইআরজিসি-তে মোসাদের অনুগত দালাল আছে। সম্ভবত ইরানের খুব ভিতরেই বিদ্রোহী বা ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, কাশেম সোলাইমানির মৃত্যু ছাড়াও বিগত অনেক হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া সত্ত্বেও ইরান তেমন আহামরি পদক্ষেপ নিতে পারেনি, কারণ হয়ত (১) ইরান ইসরায়েলের পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার ভয়ে আছে, (২) নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে আছে (যদি সরকারপ্রধানই হত্যার শিকার হন ভিতরের বিদ্রোহীরা ফায়দা হাসিল করবে এই ভয়ে), (৩) একান্তই যুদ্ধ বাধলে আম-ছালা দুটোই যাওয়ার শঙ্কা আছে।

ইরান কিন্তু একটা উল্টো খেলা খেলতে পারত!ইসরায়েলের যে পারমাণবিক বোমা আছে এর কোন শক্ত প্রমাণ নেই, ইরান যদি ইসরায়েলের গোপন কার্যক্রমের প্রমাণ বর্হিবিশ্বে প্রচার করে ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারত অন্তত আদর্শগত স্থান থেকে ইরান-ইসরায়েল সমতা হয়ে যেত।

ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা VAJA নিঃসন্দেহে অনেক দূর্বল। ইউক্রেনের যাত্রী বিমানকে শত্রু বিমান মনে করে যারা হামলা করে উড়িয়ে দেয় তাদের থেকে কি বা আশা করা যায়। এখন ইরান আবার হয়ত আসাদ এয়ারপোর্টে বা ইরাকের গ্রিনজোনে হামলা চালিয়ে ইরানিদের সান্ত্বনা দিবে 😀

৮০ শতাংশ যুক্তিই ইসরায়েলকে এই হামলার জন্য দায়ী করবে তাই আমার উত্তরে আমিও ইসরায়েলকেই দায়ী বলে বিবেচনা করছি।

No comments

Powered by Blogger.